ব্যালট বাক্স ছিনতাই, হামলা, সংঘর্ষ, ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় ঢাকার কেরানীগঞ্জ, যশোর, জামালপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে মোট সাতজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্নস্থানে সংঘর্ষে শতাধিক আহত হয়েছেন। সহিংসতার কারণে অনেক কেন্দ্রের ভোটগ্রহণও স্থগিত করা হয়েছে।
যশোরে নির্বাচনী সহিংসতায় আব্দুর সাত্তার বিশে (৭০) নামে এক ফেরিওয়ালা নিহত হয়েছেন। সদর উপজেলার চাঁচড়া ভাতুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল সোয়া ১১টার দিকে দুর্বৃত্তরা বোমাবাজি করতে করতে কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এ সময় কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। গোলাগুলি ও বোমা হামলার এক পর্যায়ে ফেরিওয়ালা আব্দুর সাত্তারের কপালে গুলি ও শরীরে বোমা লাগে। এতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। পরে মৃতদেহ যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মোহাম্মদ সেলিম জানান, সোয়া ১১টার দিকে কেন্দ্রের বাইরে দুই পাশ থেকে দুর্বৃত্তরা ব্যাপক বোমা বর্ষণ শুরু করেন। এরপর আত্মরক্ষায় কেন্দ্রের ভেতর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ১৫ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। গোলাগুলি ও বোমা হামলার পর কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। ওই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ৫৫০জন। সকাল ১১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ৩৩ শতাংশ ভোট পড়ে।
জামালপুরে ইউপি নির্বাচনে দুইপক্ষের সংঘর্ষে রফিকুল ইসলাম (৫০) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। মেলান্দহ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের উত্তর বালুচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার সকালে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, সকালে ভোট শুরুর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে জালভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় দুইপক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে রফিকুল ইসলাম নিহত হন।
কুমিল্লায় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সহিংসতায় একজন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন। সদর উপজেলার বারোপাড়া ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ গুলি নিক্ষেপ করলে দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে একজন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ অপর একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
এ ছাড়া সদর উপজেলার ৩ নং খোশবাস ইউপির আরিফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। এই কেন্দ্রে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে জেলার সদর দক্ষিণের পশ্চিম জোর কাননের কালিকাপুর মাদরাসা কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ওই কেন্দ্রের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বাউরিয়া ইউনিয়নের একটি কেন্দ্র দখল করতে গিয়ে নৌকা প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ শর্টগানের গুলিবর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এক পুলিশ কনস্টেবল।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের চর বাউরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুস্তাফিজুর রহমান তিনজন নিহতের বিষয়টি পরিবর্তন ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন।
মাদারীপুরে দুই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে ১৮ জন আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে সদর উপজেলার ঘটমাঝি ও ১০টার দিকে মোস্তফাপুর ইউনিয়নে সংঘর্ষ হয়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে মোস্তফাপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী কুদ্দুস মল্লিকের সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সোহরাব খানের সমর্থকদের উপর বোমা হামলা চালায়। এ সময় বোমার আঘাতে ১০ জন আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুইজনকে ফরিদপুর মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া ঘটমাঝি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের কুন্তিপাড়া সরকারি বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা লাইনে দাঁড়াচ্ছিলেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থী বাবুল আক্তার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী খলিলুর রহমান দর্জির সমর্থকদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উভয় গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের আটজন আহত হয়েছেন। ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের কারণে ঘটমাঝি ইউনিয়নের ৬, ৭ ও ৯ নং কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
ভোলায় আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের ৪ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে এ সংঘর্ষ ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, দুপুর ১২টার দিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হাসনাইন আহমেদ ও বিদ্রোহী প্রার্থী মিঠু চৌধুরীর সমর্থকদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও গুলি ছোড়ে।
এ সময় এনটিভির স্টাফ রিপোর্টার আফজাল হোসেনসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছে।
এদিকে দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদের ভোট সুষ্ঠুভাবে চলছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আবু হাফিজ। নির্বাচন কমিশনে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'সকাল ৮টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ভোটের প্রথম চার ঘণ্টায় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। আমরা মনিটরিং করছি। গণমাধ্যম, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও নিজস্ব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ভালোভাবে যাচ্ছে।'
ঢাকার কেরানীগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংঘর্ষে শুভ (৯) নামে এক শিশু নিহত হয়েছে। হযরতপুর ইউনিয়নের মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়।
রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী জানান, ভোট চলাকালে দুইপক্ষের সংঘর্ষে শিশু শুভ নিহত হয়েছে। কেন্দ্রের বাইরে এটা হয়েছে। সেখানে ওই ঘটনার পর ভোটগ্রহণ সাময়িক বন্ধ থাকলেও পরে আবার চালু হয়।
দ্বিতীয় ধাপের এ নির্বাচনে মোট ৬৩৯টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এর আগে প্রথম ধাপে সারাদেশের ৩৬ জেলার ৭১২টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সারাদেশে সহিংসতায় ১১ জন নিহত হন। ওই নির্বাচনের পর ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করে নির্বাচন কমিশন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন